Avijatrik Review: সাদা-কালোর আবহে কেমন হল ‘অভিযাত্রিক’? জেনে নিন ছবি মুক্তির আগে

নির্মল ধর: সত্যজিৎ রায় ‘অপুর সংসার’ যেখানে শেষ করেছিলেন, শুভ্রজিৎ মিত্র ঠিক সেখান থেকেই ‘অভিযাত্রিক’ (Avijatrik) ছবির সুতো ধরেননি, না ধরে ঠিকই করেছেন। সময়টা এগিয়েছে কিছুটা। অপুর চাকরিজীবনে ছেদ পড়েছে, নিজের সন্তানকে নিয়ে সে তখন বেরিয়েছে বারাণসীর উদ্দেশ্যে।

Avijatrik

বাবা আর কিশোর সন্তানের মধ্যে তখন এক অটুট বন্ধন। সেই বারাণসী যাবার পথেই অতর্কিতে দেখা হয়ে যায় পুরনো প্রেমিকা লীলার (অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়) সঙ্গে। সে তখন বিধবা। এই লীলার প্রসঙ্গটি সত্যজিৎ কিছুটা শুটিং করেও ‘অপুর সংসার’ ছবি থেকে বাদ দিয়েছিলেন। বিভূতিভূষণের রচনার প্রতি বিশ্বস্ত থেকেই শুভ্রজিৎ অপু-লীলার হারিয়ে যাওয়া প্রেমকে সুন্দর নস্টালজিয়া ও বিষাদের মোড়কে উপস্থিত করেছেন। যে কারণে এই অংশটুকু দর্শকের হৃদয়কে শোকার্ত করে। দৃশ্যগুলির উপস্থাপনা বড় আন্তরিক।

Avijatrik movie

এরপর কাজলকে নিয়ে বারাণসী ভ্রমণ, পুরনো জায়গাগুলো ঘুরতে যাওয়ার স্মৃতিগুলো ফিরে ফিরে আসে। কিছুটা ট্রাভেলগের ধরনের চিত্রায়ন, কিন্তু বেশ মসৃণ, মোলায়েম উপস্থাপনা। লোকেশনের ব্যবহারও চমৎকার। সেই পুরনো গলি কিংবা বাবার মৃত্যুর স্থানটি দেখলে, সেই পায়রা উড়ে যাওয়ার বুকভাঙা মুহূর্ত মনে পড়বেই দর্শকদের। বিক্রম ঘোষের আবহ রচনা এইসব দৃশ্যগুলোয় হৃদয় ছুঁয়ে যায়। এখানেই বিশ্বভ্রমণকারী শংকরের সঙ্গে দেখা তরুণ অপুর। আমন্ত্রণ পায় বিশ্ব ঘুরে দেখার। ইচ্ছে থাকলেও কাজলকে ছেড়ে যেতে মন চায় না অপুর। একবার সে ফিরে যায় সেই ফেলে আসা নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে। বাড়ি আর প্রায় নেই সেখানে। কিন্তু রয়েছে খুড়তুতো বোন রানু (শ্রীলেখা মিত্র)। আবার মিলিত হয়ে হারানো দুর্গাকেই যেন অপু ফিরে পায় রানুর মধ্যে।

ওই গ্রামীণ পরিবেশে এসে কাজলও অনেক স্বাভাবিক সহজ হয়ে ওঠে। অতীতের মাটিতে দাঁড়িয়ে অপু নিজের শিকড়টাকে উপলব্ধি করতে পারে। মাটির টান কি সহজে উপড়ে ফেলা যায়? যায় না। ছবিরও প্রাণবন্ত মুহূর্তগুলো যেন এখানেই তৈরি হয়। শুভ্রজিৎ অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে অপুর নিঃসঙ্গতা, একাকীত্বের মাঝেও নিজেকে নতুন করে পুনরাবিষ্কার করার বিষয়টি শিল্পীত ভঙ্গিতে এনেছেন বড়পর্দায়। এরপর গ্রাম ছেড়ে অপু-কাজলের চলে যাওয়ার মুহূর্তটিই হয়ে উঠতে পারত ছবির সব চাইতে প্রাণবন্ত এবং একই সঙ্গে বেদনা বিধুর শেষ মুহূর্ত।

Avijatrik film

কিন্তু, শুভ্রজিতের চিত্রনাট্য অপুকে সেই ওয়ান্ডারলাস্টের শরিক করবে যে! তাই তাকে আবার পরিভ্রমণে পাঠিয়ে দিলেন। সেই ভ্রমনের বর্ণনাও দেখালেন। এখানেই ছন্দপতন ঘটল। অকারণে দীর্ঘ হয়ে গেল ছবিটি। শিল্পীকে সঠিক জায়গায় থামতে জানতে হয়। না হলে, শিল্প ধর্মচ্যুত হয়। ‘অভিযাত্রিক’ সুন্দর একটি ছবি হয়ে উঠতে গিয়েও শুধুমাত্র এই ভারসাম্যের অভাবে নিখুঁত হল না।

Arpita and Sreelekha Avijatrik

বিক্রম ঘোষ এবং অনুষ্কা শংকরের সংগীত নিশ্চিতভাবে ছবিটিকে সমৃদ্ধ করেছে। সাদা-কালো ফটোগ্রাফিও শৈল্পিক ধর্মকে মান্যতা দিয়েছে। অভিনয়ে অপুর চরিত্রে অর্জুন চক্রবর্তী (Arjun Chakrabarty) একেবারেই নিজের স্টাইলে কাজ করেছেন। কিংবদন্তি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের (Soumitra Chatterjee) লিগ্যাসির বোঝার এতটুকুও তিনি নেন। ভালই করেছেন। অসুস্থ লীলার চরিত্রে অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়কে (Arpita Chatterjee) সত্যিই অসুস্থ লেগেছে। এত স্বাভাবিক তাঁর চরিত্রায়ন। সব্যসাচী হয়েছেন বিশ্বভ্রমণকারী শংকর। একেবারে ঠিকঠাক। রানুর চরিত্রে শ্রীলেখা মিত্র (Sreelekha Mitra) খুবই সাবলীল, স্বচ্ছন্দ, অভিনয় বলে মনেই হয়নি। কাজল চরিত্রের কিশোরশিল্পীও বাবা অপুর সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে। অপুর মৃত স্ত্রী অপর্ণার চরিত্রে দিতিপ্রিয়ার (Ditipriya Roy) বায়বীয় উপস্থাপনার ব্যাপারটি সুন্দর, মনোগ্রাহী।

Ditipriya in Avijatrik

একটা ব্যাপারই বেশ চোখে লাগল। পুরানো কলকাতার রাস্তায় স্বদেশী আন্দোলনকারীদের পুলিশের গুলিতে আহত হওয়ার সাজানো দৃশ্য। খুবই কাঁচা ভাবে তৈরি। অন্যথায় শুভ্রজিতের চিত্রনাট্য বেশ আঁটসাঁট। পরিবেশনাতেও রয়েছে দক্ষতার ছাপ। শুধু যদি শেষটুকু একটু সামলে দিতে পারতেন। সবশেষে প্রযোজক গৌরাঙ্গ জলানকে কুণ্ঠাহীন ধন্যবাদ এমন একটি পরিচ্ছন্ন বাংলা ছবির নেপথ্যে দাঁড়াবার জন্য। নিজের প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্য ও লিগ্যাসিকে গৌরাঙ্গ ও মধুর ভান্ডারকর আরও কয়েক পা এগিয়ে দিলেন।


  • ছবি – অভিযাত্রিক
  • পরিচালনা – শুভ্রজিৎ মিত্র
  • অভিনয়ে – অর্জুন চক্রবর্তী, দিতিপ্রিয়া রায়, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, শ্রীলেখা মিত্র, সব্যসাচী চক্রবর্তী প্রমুখ। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Please Type Your Valuable Feedback.
Keep Supporting. Flow as on YouTube & Facebook.

নবীনতর পূর্বতন