![]() |
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আমরণ সংগ্রাম করেছেন সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে। |
দু'হাজার চার সালে বিবিসি বাংলা একটি 'শ্রোতা জরিপ'-এর আয়োজন করে। বিষয়টি ছিলো - সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? তিরিশ দিনের ওপর চালানো জরিপে শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় বেতার অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয় ২০০৪-এর ২৬শে মার্চ থেকে ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত।
বিবিসি বাংলার সেই জরিপে শ্রোতাদের মনোনীত শীর্ষ কুড়িজন বাঙালির তালিকায় নবম স্থানে আসেন আবদুল হামিদ খান ভাসানী।। আজ তাঁর জীবন-কথা।
ছয় দশক ধরে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বাংলার মানুষের মন জয় করেছিলেন মওলানা ভাসানী। তাঁর আন্দোলন ছিল সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে।
তাঁর রাজনৈতিক দীক্ষা হয়েছিল ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতা চিত্তরঞ্জন দাশের কাছে। আর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বহু ঘটনার কেন্দ্রেই ছিলেন মওলানা ভাসানী, যাকে তাঁর ভক্তরা "মজলুম জননেতা" বলে সম্বোধন করতেন।
আবদুল হামিদ খান ভাসানী জন্মেছিলেন ১৮৮০ সালের ১২ই ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার ধানগড়া গ্রামে। অল্প কিছুকাল স্কুল ও মাদ্রাসায় পড়া ছাড়া তিনি অন্য কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেননি।
শৈশবে পিতামাতা হারানো আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার কড়াকড়ি পছন্দ করতে পারেননি। ১৯০৭ সাল থেকে দুবছর তিনি দেওবন্দ মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন। কিন্তু সেখানে বিদ্যাশিক্ষার চেয়ে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামী রাজনৈতিক চেতনায় বেশি দীক্ষা গ্রহণ করেন তিনি।
তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় টাঙ্গাইলের কাগমারি স্কুলের শিক্ষক হিসাবে ১৯০৯ সালে।
![]() |
১৯০৭ সাল থেকে দুবছর মওলানা ভাসানী দেওবন্দ মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন |
তাঁর জীবনযাপন ছিল খুবই অনাড়ম্বর। জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি কাটিয়েছিলেন ঢাকা থেকে প্রায় একশ কিলোমিটার দূরে টাঙ্গাইলের সন্তোষে এক অতি সাদামাটা ঘরে।
উনিশশ' দশ থেকে উনিশশ' সাতচল্লিশ পর্যন্ত তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কেন্দ্রীভূত ছিল মূলত বাংলা ও আসামের কৃষকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের মধ্যে।
চিত্তরঞ্জন দাশের সাহচর্যে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে তিনি প্রবেশ করেন ১৯১৭ সালে তার জাতীয়তাবাদী দলে যোগদানের মাধ্যমে। ১৯১৯ সালে কংগ্রেসের প্রাথমিক সদস্য হন তিনি।
সেই সময়ই তিনি প্রথমবারের মত কিছুদিনের জন্য কারাবাস করেছিলেন, যখন অনেক খ্যাতনামা রাজনৈতিক কর্মী ও নেতার সংস্পর্শে এসেছিলেন তিনি।
আসামের ধুবড়ী জেলার ভাসানচরে তিনি এক বিশাল কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেছিলেন। যার পর লোকমুখে তিনি "ভাসানচরের মওলানা" বা "ভাসানীর মওলানা" হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। পরবর্তীকালে "ভাসানী" শব্দটি তাঁর নামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে যুক্ত হয়ে যায়।
![]() |
উনিশশ' সাতচল্লিশ পর্যন্ত মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কেন্দ্রীভূত ছিল মূলত বাংলা ও আসামের কৃষকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের মধ্যে। |
লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বিবিসি বাংলাকে বলেন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে মওলানা ভাসানী যে ভূমিকা রেখেছিলেন তার দুটি পর্যায় ছিল।
"এর একটি ছিল ১৯৪৭ পূর্ব সময়ে অর্থাৎ ১৯১০ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত। এই পর্যায়ে আন্দোলনের প্রধান ক্ষেত্র ছিল আসাম। সেখানে তিনি বাংলাভাষী কৃষকদের অধিকার আদায়ের জন্য আপোষহীন সংগ্রাম করেন। শেষ পর্যন্ত সেই লড়াই শুধু সামন্তবাদের বিরুদ্ধে নয়, ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধেও পরিচালিত হয় তাঁরই নেতৃত্বে।"
"তিনি ১৯৩৭ সালে আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদের বাইরে রাজপথে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। আসামের কুখ্যাত 'লাইন প্রথার' বিরুদ্ধে তাঁর যে সংগ্রাম, তা দক্ষিণ আফ্রিকায় মহাত্মা গান্ধীর বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে তুলনীয়," বলেন সৈয়দ আবুল মকসুদ।
মওলানা ভাসানী ১৯৩২ সালের ডিসেম্বরে সিরাজগঞ্জের কাওয়াখালিতে বঙ্গ-আসাম প্রজা সম্মেলন নামে এক ঐতিহাসিক কৃষক সমাবেশ আয়োজন করেছিলেন।
ওই সম্মেলনে জমিদারি উচ্ছেদ, খাজনার নিরীখ হ্রাস, নজর-সেলামি বাতিল, মহাজনের সুদের হার নির্ধারণসহ বহুবিধ প্রস্তাব গৃহীত হয়, যার ফলে ১৯৩৬ সালে বঙ্গীয় কৃষি খাতক আইন পাশ হয়েছিল এবং ১৯৩৭ সালে ঋণ সালিশী বোর্ড স্থাপিত হয়েছিল।
"মজলুম জনতার" মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ১৯৩০ সালে মওলানা ভাসানী মুসলিম লীগে যোগদান করেছিলেন। কিন্তু দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান জন্মের দু বছরের মধ্যেই তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে,'' বলেছেন সৈয়দ আবুল মকসুদ।
"তখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী মুসলিম লীগ- পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তার সভাপতি ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে কৃষক, শ্রমিক, যুবক ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ ভাষা আন্দোলনে লড়াই করেছে।"
তিনি সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদেরও সভাপতি ছিলেন। ১৯৫৪ সালে তাঁর এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও ফজলুল হকের যৌথ নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসে।
উনিশশ আটচল্লিশ সালে উত্তর টাঙ্গাইলের একটি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবার পর থেকে আজীবন তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
![]() |
সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। এই ছবিতে মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখা যাচ্ছে ১৯৫৩ সালে খালি পায়ে ভাষা শহীদদের স্মরণে প্রভাত ফেরীতে অংশ নিতে। |
শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন মওলানা ভাসানী সাম্প্রদায়িকতার ঘোর বিরোধী ছিলেন।
"তিনি চেয়েছিলেন সকল জনগণের মুক্তি। তাই অসাম্প্রদায়িক একটা রাজনীতি গড়ে তোলার প্রয়োজনে পরে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেবার পক্ষে ছিলেন। বলা যায় তাঁর উদ্যোগেই শব্দটি পরে বাদ পড়ে।"
মি. চৌধুরী বলেন গোটা পাকিস্তান শাসনামলে তাঁর রাজনীতির দুটি বড় উপাদান ছিল স্বাধীনতা অর্জন এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা এবং এই দুই প্রশ্নেই আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তাঁর সঙ্গে আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্বের বিরোধ তৈরি হয়। ''এ কারণেই পরবর্তীতে তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গেও আর থাকতে পারেননি।"
মওলানা ভাসানী এরপর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা এবং আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনকে প্রধান গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় করে ১৯৫৭ সালে একটি নতুন দল গঠন করেন যার নাম দেন ন্যাশানাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ।
"মওলানা ভাসানী নিজে একজন মওলানা ছিলেন। তিনি পীরও ছিলেন। কিন্তু তিনি ওইখানে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন মানুষের মুক্তি। তাঁর কাছে স্বাধীনতার অর্থ ক্ষমতার হস্তান্তর ছিল না। তাঁর কাছে স্বাধীনতার অর্থ ছিল রাষ্ট্রের চরিত্রে মৌলিক পরিবর্তন আনা। স্বাধীনতার অর্থ ছিল রাষ্ট্রকে জনগণের রাষ্ট্রে পরিণত করা এবং সমাজে বৈষম্য দূর করা," বলেছিলেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
মওলানা ভাসানী ১৯৬৮-৬৯ সালে আরেকবার জাতীয় রাজনীতির কাণ্ডারী হিসাবে আর্বিভূত হন। ৬৯-এর গণ অভ্যুত্থানের পেছনে তাঁর ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী নেতা এবং পঞ্চাশের দশকেই তিনি নিশ্চিত হয়েছিলেন যে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি অচল রাষ্ট্রকাঠামো।
![]() |
১৯৬৯এ মওলানা ভাসানী যে গণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তা পরবর্তীতে মুক্তি সংগ্রামের জন্য ভিত রচনা করেছিল। |
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুরু থেকেই তিনি তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছিলেন। তাতে কাজ না হওয়ায় আন্দোলনের পথ নেন মওলানা ভাসানী। এর ফলে মুক্তি পান শেখ মুজিবুর রহমান এবং ওই রাতেই ভাসানীর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় বসেন তিনি।
১৯৬৮ সালের নভেম্বরে ছাত্র অসন্তোষকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়, তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল শহর এবং গ্রামের শ্রমিক-কৃষক ও নিম্ন-আয়ের পেশাজীবীসহ বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষের মধ্যে৷ আটষট্টির সেই ছাত্র অসন্তোষ গণআন্দোলনে রূপান্তরিত হয় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে।
উনিশশ' সত্তর সালের ২৩শে নভেম্বর পল্টন ময়দানে মওলানা ভাসানী স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের ঘোষণা দেন, যার পর শুরু হয় রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রাম। তিনি চলে যান ভারতে। কিন্তু সেখানে তিনি কার্যত নজরবন্দি ছিলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসার পর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী একটা গঠনমূলক বিরোধী রাজনীতির সূচনা করেছিলেন। সেইসময় যেসব নির্যাতন নিপীড়ন হতো তিনি তার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট প্রতিবাদ জানিয়েছেন, বিবিসি বাংলাকে বলেন অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ।
"তিনি যখন লক্ষ্য করলেন প্রতিবেশী দেশ ভারত বাংলাদেশের ওপর কিছু কিছু শর্ত চাপিয়ে দিচ্ছে, তিনি তারও প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি ভারতকে বন্ধু হিসাব পেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা সমতার ভিত্তিতে, সৌহার্দ্যের ভিত্তিতে। ভারত যখন ফারাক্কা বাঁধ দিল এবং তার ফলে বাংলাদেশে মরুকরণের আশংকা তৈরি হল, তখন তিনি আন্দোলন মিছিল সংগঠিত করেন।"
![]() |
দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মুক্তির জন্য লড়াই করে গেছেন। |
তাঁর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আর একটি ঘটনা ছিল ১৯৭৬ সালের ১৬ই মে ফারাক্কা বাঁধ অভিমুখে লং-মার্চ।
সমাজের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই ছিল তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য। দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের অন্তিম দিনগুলোতেও তিনি সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মুক্তি আন্দোলনের সাথে ছিলেন।
১৯৭৬ সালের ১৭ই নভেম্বর মওলানা ভাসানী মারা যান ঢাকায়। তাঁকে কবর দেওয়া হয় টাঙ্গাইলের সন্তোষে।